১০ই মে, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ রাত ৪:০৪
সংবাদ শিরোনাম
ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ নিয়ে ৫ ভবিষ্যদ্বাণী ইন্তেকাল করেছেন রাষ্ট্রদূত মুশফিকের বাবা শান্তিগঞ্জে জোরপূর্বক জায়গা দখলের প্রতিবাদে মানববন্ধন লালাবাজারে জনগণের দোরগোড়ায় সেবা কার্যক্রমের উদ্বোধন কৃষি জাতীয় উন্নয়ন অগ্রগতির প্রধানতম হাতিয়ার : অতিরিক্ত পরিচালক ড. মোঃ মোশাররফ হোসেন সিলেটে কবি মুকুল চৌধুরীর স্মরণসভা ও দোয়া মাহফিল হাজী আব্দুস সাত্তার উচ্চ বিদ্যালয়ের ৪ জন শিক্ষকের বিদায় সংবর্ধনা অনুষ্ঠিত সিলেট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অভ্যর্থনা অনুষ্ঠান সম্পন্ন পাগলা-বীরগাঁও রাস্তায় ভাঙন, চরম ভোগান্তির আশঙ্কায় জনসাধারণ ফেইসবুক পোস্ট : বিশিষ্টজনের কাছে ঔপন্যাসিক সিরাজুল হক

সিলেটের সম্পদে কারা ধনী হয়?

আকাশ বাংলা ডেস্ক
  • আপডেট বৃহস্পতিবার, ১ মে, ২০২৫
  • ৩২ বার পঠিত
১৭৫৭ সালের পলাশীর বিপর্যয়ের পর সিলেটের ভাগ্য নতুন করে লিখা হয়ে যায়। হাজার হাজার বছরের স্বাধীন ও সমৃদ্ধ সভ্যতার লীলাভূমি এই জনপদ প্রবেশ করে নতুন এক শাসনব্যবস্থায়। এর নাম ‘কলোনিয়াল রুল’ বা ঔপনিবেশিক শাসনব্যবস্থা!
১৭৭২ সালে সিলেটে শুরু হয় ‘কলোনিয়াল এক্সপ্লয়িটেশন’ বা ঔপনিবেশিক শোষণ-লুণ্ঠন। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কালেক্টর উইলিয়াম মেকপিস থেকারে এর সূচনা করেন। ১৭৭৮ সালে নতুন কালেক্টর রবার্ট লিন্ডসে এসে এই শোষণ-লুণ্ঠনের মাত্রা আরও বাড়িয়ে দেন।
তবে লিন্ডসে পুরো সিলেটকে কলোনাইজ করতে পারেননি। সিলেটের একাংশ তখনও স্বাধীন ছিল। এই অংশটি হল স্বাধীন রাজ্য জৈন্তিয়া। ১৮৩৫ সালে ক্যাপ্টেন হেরি ইংলিশের জৈন্তিয়া দখলের পরে পুরো সিলেট অঞ্চল কলোনাইজেশনের আওতায় আসে।
১৯৪৭ সাল পর্যন্ত ব্রিটিশদের এই কলোনাইজেশনে কোন ছেদ পড়েনি। সিলেট থেকে তারা কয়েক লক্ষ কোটি টাকার সম্পদ লুট করে নিয়ে যায়। ব্রিটিশদের পরেও সিলেটের ভূমি ও সম্পদ লুন্ঠনের এই ধারাবাহিকতা বজায় থাকে। তবে মাত্রাটা কিছুটা কমে আসে বৈকি।
পাকিস্তান সরকার জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত করে দেশে কিছুটা পরিবর্তন আনলেও অনেক কিছু ব্রিটিশ আমলের মতোই থেকে যায়। পাকিস্তান সরকার ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তারাই বসে ছিলেন। এসব কর্মকর্তারা দেশের মানুষের স্বার্থের চেয়ে নিজেদের স্বার্থকেই প্রাধান্য দিতেন।
পাক সরকারের এমনই একজন কর্মকর্তা ছিলেন সিলেটের ডেপুটি কমিশনার (ডিসি) মিস্টার হাসান। ব্রিটিশ আমলের ডিসিদের মতো পাক আমলেও তিনি ঔপনিবেশিক স্টাইলে সিলেট শাসন করতেন। থেকারে ও লিন্ডসের রেখে যাওয়া পদে বসে তিনি তাদের মতোই সিলেট শাসন করেছেন (সিলেটের ডেপুটি কমিশনারের পদটি ছিল থেকারে ও লিন্ডসেরই রেখে যাওয়া পদ)।
থেকারে, লিন্ডসে ও হ্যারি ইংলিশের মতোই তিনিও এই দেশের কেউ ছিলেন না। তিনি বাঙালি কিংবা সিলেটি ছিলেন না। তার বাড়ি বাংলাদেশে ছিল না। ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কর্মকর্তাদের মতোই তিনি নিজের ভাগ্য গড়ার উদ্দেশ্যে প্রথমে ব্রিটিশ সরকার ও পরে পাক সরকারের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা হয়েছিলেন; নিজের জন্মভূমি ছেড়ে অন্য জায়গায় চাকুরী নিয়েছিলেন।
সাবেক ব্রিটিশ সরকারের এই কর্মকর্তা পাক সরকারের সাথে ব্যালেন্সিং করে বেশ সফলভাবেই নিজ স্বার্থ রক্ষা করতে পেরেছিলেন। প্রচুর অর্থ, যশ ও প্রতিপত্তি লাভ করেছিলেন৷ সিলেটের ভূ-প্রাকৃতিক সম্পদকে নিজের মনমতো ইজারা ও বন্দোবস্ত দিয়ে প্রচুর লাভবান হয়েছিলেন তিনি।
ব্রিটিশ কর্মকর্তাদের মতো তিনিও সিলেট শহরে নিজের নামের স্বারক রেখে গিয়েছেন! মিস্টার ক্ষিনের নামে হয়েছিল ক্ষিন ব্রিজ। আর মিস্টার হাসানের নামে হয়েছিল হাসান মার্কেট। আজ অবধি এ দুটি স্থাপনা সিলেটের প্রতীক হিসেবে কাজ করছে।
ডিসি হাসানের চেয়েও বড় কলোনাইজার ছিলেন ডিসি খোরশেদ আলম। তিনি সরাসরি ব্রিটিশ সরকারেরই ডিসি ছিলেন। ব্রিটিশ আমলের শেষ দিকে অর্থাৎ ১৯৪০ এর দশকে তিনি সিলেটের ডিসি হয়েছিলেন (সম্ভবত পাকিস্তান আমলেও কিছুদিন সিলেটের ডিসি ছিলেন)। তিনিও বাঙালী কিংবা সিলেটি ছিলেন না।
ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তা হিসেবে তিনি অনেক দূর হতে (বর্তমান পাকিস্তান থেকে) সিলেটে এসেছিলেন। সিলেটের কলোনাইজেশনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিলেন। বিহারের অনেক মানুষকে তিনি সিলেটের ভূমি দান করেছিলেন। সুকৌশলে সিলেটের ডেমোগ্রাফি বদলে দিতে চেয়েছিলেন তিনি। অনেকটা বদলেও দিয়েছিলেন।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বা ব্রিটিশ সরকারের কর্মকর্তারা নিজের নামে বা পরিবারের লোকজনের নামে জমি বন্দোবস্ত নিতেন। খোরশেদ আলমও এই কাজে দারুণ সফলতা দেখিয়েছিলেন। সিলেটের জৈন্তিয়া থেকে তার ভাই ক্যাপ্টেন রশীদকে ১০০০ একর ভূমি লিজ দিয়েছিলেন তিনি! জায়গাটি ছিল শ্রীপুর চা-বাগান।
ক্যাপ্টেন হেরি ইংলিশের মতো ক্যাপ্টেন রশীদও অন্য দেশ থেকে এসে জৈন্তিয়ার প্রাকৃতিক সম্পদ লুট করে ধনী হয়েছিলেন! সরকার বা ক্ষমতাসীনদের সাথে ব্যালেন্সিং করে নিজের সম্পদ ও কলোনি রক্ষায় তিনি ছিলেন বেশ পটু। নিজের সম্পদ ও ‘কলোনি’ রক্ষার্থে পাক সরকারের সাথে বেশ ভালো সম্পর্ক রাখতেন তিনি।
১৯৭১ সালে পশ্চিম ও পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে ক্যাপ্টেন রশীদ পাক-বাহিনীর পক্ষে অবস্থান নেন। রাজাকার বাহিনীর সহায়তায় অনেক মুক্তিযোদ্ধা ও সাধারণ মানুষকে নির্বিচারে হত্যা করেছিলেন তিনি। মুক্তিযোদ্ধারাও তাকে সহজে ছেড়ে দেয়নি। নিজ চা-বাগান অর্থাৎ শ্রীপুর চা-বাগানের বাংলোয় মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে নিহত হয়েছিলেন তিনি।
মুক্তিযোদ্ধারা ক্যাপ্টেন রশীদকে হত্যা করে শ্রীপুর চা-বাগানের বাংলোটি পুড়িয়ে দিয়েছিল! ভাবতেই অবাক লাগে, এই ক্যাপ্টেন রশীদের পুত্র ইমরান আহমদ আওয়ামী লীগ সরকারের মন্ত্রী হয়েছিলেন! শুধু তাই নয়, তিনি ৭ বার আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে এমপি হয়েছিলেন!
কলোনাইজার খোরশেদ আলমের ভাতিজা ও ক্যাপ্টেন রশীদের পুত্র ইমরান আহমদ জন্মগতভাবেই একজন কলোনাইজার ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান বা বাংলাদেশ তাদের নিজেদের দেশ ছিল না। ভীনদেশে নিজেদের পারিবারিক সাম্রাজ্য টিকিয়ে রাখতে হলে ক্ষমতাসীনদের সাথে ব্যালেন্সিং না করে তাদের কোন উপায় ছিল না।
ডিসি হাসান, খোরশেদ আলম এবং ক্যাপ্টেন রশীদের মতো ইমরান আহমদও এক্ষেত্রে শতভাগ সফল হয়েছিলেন। স্বাধীন বাংলাদেশে নিজেদের পারিবারিক ‘কলোনি’ টিকিয়ে রাখার জন্য শেখ পরিবারের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ এক পরিবারে বিয়ে করে ফেলেছিলেন তিনি! এটিই ছিল তার জীবনের সবচেয়ে ‘লাভজনক’ সিদ্ধান্ত!
মহিলা আওয়ামী লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি বেগম বদরুন্নেসার কন্যা নাসরিনকে বিয়ে করে তিনি জীবনের সবচেয়ে সফল চালটি চেলেছিলেন। বেগম বদরুন্নেসা ছিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ। এদিকে নাসরিনও ছিলেন বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার ঘনিষ্ঠ বান্ধবী!
পয়সাওয়ালা কলোনাইজার পরিবারের সন্তান ইমরান আহমদ হয়তো জায়গামতো টাকা-পয়সাও ঢালতেন। এসবে কাজ হয়েছিল। মুজিবকন্যার ‘বান্ধবীর স্বামী’ কোটায় তিনি মন্ত্রী হয়েছিলেন। সিলেট-৪ আসন অর্থাৎ জৈন্তিয়া আসন থেকে মোট ৭ বার এমপি হয়েছিলেন তিনি। আসনটিকে একপ্রকার ‘কিনে নিয়েছিলেন’ তিনি।
জৈন্তিয়া বা সিলেট ইমরানের নিজের এলাকা নয়। তিনি চাইলে ঢাকার কোন আসন থেকেও এমপি হতে পারতেন। তবুও তিনি জৈন্তিয়াকেই বেছে নিয়েছিলেন। এর কারণ খুবই স্পষ্ট। বাপ-চাচার মতো ইমরানও জৈন্তিয়াকে ‘কলোনাইজ’ করতে চেয়েছিলেন। করেছেনও। দীর্ঘদিন তিনি জৈন্তিয়াকে নিজের ‘কলোনি’ বানিয়ে রেখেছিলেন।
জৈন্তিয়া আসনটি হল সোনার খনি! এটি সিলেটের সম্পদের ভাণ্ডার। এই আসনে যে এমপি হয় সে টাকার কুমীরে পরিণত হয়ে যায়! এতো টাকা সিলেটের আর কোন আসন থেকে আয় করা যায় না। তাই মাফিয়া বা শকুনদের চোখ জৈন্তিয়া আসনের দিকেই পড়ে থাকে। মাফিয়া বা শকুনদের মধ্যে যে হেরি ইংলিশের মতো ধূর্ত ও কৌশলী হতে পারে সেই এই আসনটি পায়।
ক্যাপ্টেন হেরি ইংলিশ ও ক্যাপ্টেন রশীদের যোগ্য উত্তরসূরী হিসেবে ইমরান সাত সাতটি বার জৈন্তিয়ার এমপি হয়েছিলেন। জৈন্তিয়াকে তিনি মনেপ্রাণে নিজের ‘কলোনি’ ভাবতেন। জৈন্তিয়ার জন্য দৃশ্যমান কোন উন্নয়ন না করলেও নিজের ও নিজ পরিবারের জন্য সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলেছেন। ‘হাসান মার্কেট’ স্টাইলে নিজের নামে ও পিতার নামে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামকরণ করেছেন।
এমপি/মন্ত্রী থাকাকালীন সময়ে জৈন্তিয়াবাসীর দাবী-দাওয়া নিয়ে দেখা করতে গেলে ইমরান ধমক দিয়ে বিদায় করতেন। দাবী-দাওয়াভিত্তিক সংগঠনগনগুলোকে তিনি পছন্দ করতেন না। এসব আন্দোলনে কোন লাভ নেই বলে নিরুৎসাহিত করতেন। জৈন্তিয়া কেন্দ্রীয় পরিষদের কার্যক্রম নিয়ে প্রকাশ্যেই বিরুপ মন্তব্য করতেন।
ইমরান আহমদ জৈন্তিয়া শাসন করতে এসেছিলেন। করেছেনও। অত্যন্ত সফলভাবে কয়েক দশক ধরে তিনি এই জনপদকে শাসন ও শোষণ করেছেন। জৈন্তিয়াজুড়ে জনগণের প্রাকৃতিক সম্পদ লুন্ঠন/ইজারা/বন্দোবস্তের যে হিড়িক পড়েছিল তা তারই মদদে হয়েছিল। ‘দূর থেকে মোটা অংকের ভাগ’ নিয়ে তিনিই এসবের সুযোগ সৃষ্টি করে দিতেন।
জৈন্তিয়াকে চোরাকারবারের একটি স্বর্গরাজ্যে পরিণত করেছিলেন তিনি। জৈন্তিয়ার হাজার হাজার কোটি টাকার গ্যাসের সুবিধা যারা পায় তিনি ছিলেন তাদেরই দলের একজন। এজন্য জৈন্তিয়ায় তিনি কোন গ্যাসের আন্দোলন গড়ে উঠতে দেননি। দাবী-দাওয়াভিত্তিক সংগঠনগুলোকে তিনি একপ্রকার কোণঠাসা করেই রেখেছিলেন।
২০২২ সালের বন্যায় জৈন্তিয়াবাসী ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হলে ইমরান আহমদ ত্রাণ বিতরণের কয়েকটি ছবি তোলেন। ছবি তোলার পর ত্রাণসামগ্রী আবার ফিরিয়ে নেওয়া হয়! এজাতীয় ঘটনা ইতিহাসে সত্যিই বিরল ব্যাপার! ইমরান জৈন্তিয়াবাসীকে ‘নিজস্ব কলোনির গোলাম’ ছাড়া আর কিছুই ভাবতেন না। জৈন্তিয়ার মানুষের সাথে তিনি খুবই দূর্ব্যবহার করতেন।
জৈন্তিয়াকে লুটেপুটে খেয়ে, হাজার হাজার কোটি টাকা বানিয়ে বিদেশী ও বহিরাগত ইমরান আহমদ সময়মতো দৃশ্যপটের আড়ালে চলে গিয়েছেন। তিনি ফিরে আসার আর কোন সম্ভাবনা নেই। কিন্তু নতুন কোন ইমরান আহমদ এসে জৈন্তিয়া দখল করবেন না বলে কোন নিশ্চয়তা নেই।
যদি জৈন্তিয়াবাসী নিজেদের ভাগ্য নিজেরাই গড়তে না পারে তাহলে অচিরেই হয়তো নতুন কোন মাফিয়ার কব্জায় তাদেরকে চলে হবে। যদি সিলেটবাসী নিজেদের অধিকার আদায়ে সচেতন না হয় তাহলে অচিরেই হয়তো নতুন কোন থেকারে, লিন্ডসে, ডিসি হাসান, ডিসি খোরশেদ এসে তাদেরকে গোলামে পরিণত করবে।
(যদি আপনি ধৈর্য্য সহকারে পুরো লেখাটি পড়ে থাকেন তাহলে এটি প্রচার করে সিলেটবাসীকে সচেতন হওয়ার সুযোগ দিতে পারেন)
লেখক: আসিফ আযহার, বার্মিংহাম, যুক্তরাজ্য

সংবাদটি ভালো লাগলে শেয়ার করুন

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

এই ধরনের আরও সংবাদ
© All rights reserved © 2025 AkashBangla. Developed by PAPRHIHOST
Theme Dwonload From Ashraftech.Com
ThemesBazar-Jowfhowo